Close

“বিনামূল্যে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশিক্ষণ, সবুজসাথী-র সাইকেল ও দিন-রাত পড়াশোনাই আজ আমায় মুম্বই আইআইটি তে পৌঁছে দিয়েছে”:বিপ্লব সিংহ

✍️ঈশানী মল্লিক

ভাগচাষী হওয়ার নিজের ভাগ্য নিজেই বদলাল বিপ্লব সিংহ

কথায় বলে, ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে নেই।’— কিন্তু এখানে কাঁথা তো দূরে থাক; মাথা গোঁজার জায়গা বা পাকা একটা শৌচালয়ও নেই। তবে কিভাবে নিজের ‘অভিষেক সিরিজটা’ একনিষ্ঠতার সঙ্গে জিতে নিলেন বিপ্লব সিংহ?
রইল বিশেষ প্রতিবেদন সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের বাইশ গজের আইকন সৌরভ গাঙ্গুলীর সাক্ষাৎকার।

আপনি কি জীবনের এই সাফল্যে নদীয়া জেলার চকদাহের ধানতলার মাটিতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন?
তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। তবে আমি যে আইআইটি মুম্বাইতে পড়ার সুযোগ পেয়েছি সেটাই কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। আমাদের বাড়ির চারপাশের মানুষ আমার এই সুযোগকে আইটিআই এর কোনো কোর্স ভাবছে। তবে আমার এলাকায় আমিই প্রথম যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি বা পড়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর ও ওয়েস্ট বেঙ্গল এসসি, এসটি ও ওবিসি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফিনান্স কর্পোরেশন – এর যৌথ উদ্যোগে প্রবেশিকা পরীক্ষার কোচিং তোমার স্বপ্ন পূরণে কতটা ভূমিকা নিয়েছে?

   ভগবানের আশীর্বাদ যে ক্লাস নাইন-এ অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ দপ্তরের দেওয়া সবুজ সাথীর সাইকেল পাওয়ার পর থেকে আমি দূরে কাজের জন্য হোক বা এই কোচিং করতে যাওয়া, স্কুল সবটাই নিখরচে সাইকেলের মাধ্যমে যাতায়াত করে করতে পেরেছি। নইলে আমার মতো একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের পক্ষে আজ স্বপ্নপূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। 

আমি পাঠ্য বই ও ইন্টারনেটের মাধ্যমেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যেখানে যখন অসুবিধা হতো তখন স্কুলের শিক্ষকদের থেকে জেনে নিতাম। বিনামূল্যে জয়েন্টের কোচিং আমায় প্রস্তুতির ধার-এ আরো বেশি করে শান দিয়েছে। এখানে যারা পড়াতেন তারা খুবই সহযোগিতা করেছেন। প্রতি সপ্তাহে ২ দিন ক্লাস হতো। প্রতি ক্লাসের আগেই শিক্ষকরা আগের দিনের পড়া জিজ্ঞেস করতেন, কারোর কোনো সমস্যা থাকলে প্রত্যেককে আলাদা করে বোঝাতেন। ক্লাসে যদি কেউ পিছিয়ে তাহলে তাদের আলাদা সময় দিয়ে ক্লাস করানো হতো। করোনার সময় বলে প্রথমদিকে অনলাইনে ক্লাস করানো হয়। কোচিং এর শুরুতেই বিনামূল্যে আমাদের স্টাডি মেটেরিয়াল দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি ক্লাসের জন্য স্টাইপেন্ড দেওয়া হতো। এই মাসিক ৩০০ টাকা আমার ইন্টারনেটের রিচার্জ করতে খুবই কাজে এসেছে।
এই পুরো কোচিংয়ের মধ্যে মৃণাল চক্রবর্তীর মোটিভেশনাল ক্লাস আমায় মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে, পরীক্ষার আগের চিন্তা, পরীক্ষার সময় ঘাবড়ে গিয়ে যাতে পরীক্ষা খারাপ না হয়ে যায় সেই বিষয়ে মনস্থির করতে , একাগ্রভাবে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে খুবই সাহায্য করেছে। আমাদের স্যার কিছু ট্রিক্সও শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

আপনি তো প্রথমবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পাশাপাশি প্রবেশিকা পরীক্ষায়ও ভালভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তারপরও কেন এক বছর আবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রস্তুতি নিলেন?
আমার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হব। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। প্রথম থেকে আমার স্কুলের শিক্ষকরাই ইঞ্জিনিয়ারিং য়ের প্রস্তুতির জন্য সাহায্য করেন। তারপর গত বছর আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে অটো প্রচারের মাধ্যমে জানতে পারি যে, অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর ও ওয়েস্ট বেঙ্গল এসসি, এসটি ও ওবিসি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ফিনান্স কর্পোরেশন বিনামূল্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেবে এসসি ও এসটি ছেলে মেয়েদের। সঙ্গে সঙ্গেই আমি লিফলেটে থাকা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে এই বিনামূল্য কোচিংয়ের জন্য ফর্ম ফিলাপ করে ভর্তি হয়ে যাই। আমি নিশ্চিত ও জেদ নিয়েছিলাম যে, দিন রাত এক করে খেটে পড়াশোনা করে মুম্বাই আইআইটি থেকেই পড়াশোনা করব।

মোবাইল ইন্টারনেট অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার এই মুহূর্তে পড়ুয়াদের জন্য কতটা কী ধরণের ভূমিকা পালন করছে?
এখন ফোন, ইন্ডটারনেট না থাকলে কোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকে রিসার্চ করে পড়া সম্ভব নয়। কেউ কেরিয়ার তৈরিও করতে চাইলে নিজেই ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার করবে।

“কাজের প্রতি অনুগত ও একনিষ্ঠ হও, উৎকর্ষ আপনিই ধরা দেবে”—
সৌরভ গাঙ্গুলী (প্রাক্তন বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট ও অধিনায়ক ক্রিকেট আইকন):
ব্যাকরণ বই সরিয়ে রেখে অনেকেই অতীতে জীবনের বা খেলার মাঠের ইনিংসে রান করেছেন। তোমরাও ভবিষ্যতের ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার। তবে জীবনেরও একটা নির্দিষ্ট ব্যাকরণ বই নিজের পড়াশোনা বা পেশা অনুযায়ী তৈরি করা উচিত। ‘নিয়মানুবর্তিতা’ যে কোনো কাজের প্রতি ‘অনুগত’ হয়ে সেই কাজেই নিজের ফোকাসটা রাখা এবং “পরে হবে” এই দু’টি শব্দ জীবনের অভিধান থেকে বাদ দিতে পারলে তবেই সফলতার দিকে এগোনো যাবে। । নইলে জীবন অনিশ্চিত। শুধু আমাদের রাজ্য নয়, গোটা দেশে পরিকাঠামো ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে
সুযোগ রয়েছে। বিব্লপ- এর মতো প্রতিভার খনি অনেক আছে। দরকার শুধুমাত্র সঠিক প্রচার, ও বিপ্লবের উদাহরণ দিয়ে এই কমিউনিটিকে বোঝানো, প্রচেষ্টা ও একাগ্রতা।
তবে আজকের এই রেজাল্ট একটা পদক্ষেপ মাত্র। যত ভাল নম্বরই আজ পেয়ে থাক, সফল হওয়ার তুলনায় জীবনে অনেকবার ব্যর্থ হওয়া প্রয়োজন। এটাই স্বাভাবিক। ব্যর্থ মুহূর্তে তোমার চটজলদি সিদ্ধান্ত কিভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে আবার মেইন স্ট্রিম-এ আনবে সেটা তখন মাথা ঠাণ্ডা করে তোমাকেই ভাবতে হবে । খেলার খেত্রে একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, ৫০ রান পাওয়াকে যদি কেউ ক্রিকেটে সাফল্য বলেন, তবে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানরা ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছেন।
নিজেকে চাবুকের মতো তৈরী করতে হবে যেন সব সময় তুমি নতুন নতুন কাজ করে যেতে পার। উৎকর্ষের পিছনে ছুটলে হবে না। যে কাজটা করছ সেটাতেই ডুবে থাক দেখবে সম্মান, তোমায় নিয়ে উন্মাদনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে। ক্রিকেটার ববি মুর ১৯৬৬ সালে রানীর হাত থেকে ‘জুলে রিমে ট্রফি’ নেওয়ার সময় হাতের ঘাম মুছে তারপর ট্রফি নিয়েছিলেন। কারন খেলায় ফোকাস করে আরো ভাল কিভাবে খেলা যায়, কিভাবে নিজেকে ফিট রাখা যায় এগুলো ভাবতে গিয়ে উনি এতটাই এগিয়ে ছিলেন যে সম্মান নেওয়ার জন্য আলাদা করে তৈরী হয়ে যেতে পারেন নি। এছাড়া মার্টিন জনসন যখন ‘ওয়েব এলিপ কাপ’ জেতেন তখন ট্রফি নেওয়ার সময় তার নাক থেকে রক্ত ঝরছিল। ঘাম ঝরা হোক বা রক্ত ঝরা আসল সাফল্য এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
সবার জন্যই আমার শুভেচ্ছা রইল। সরকারি এই উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। আগামীদিনে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলে কেরিয়ার গড়তে সুবিধা হবে।

Leave a Reply

0 Comments
%d bloggers like this:
scroll to top