প্রয়াত বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তাঁর অন্ত্যেষ্টির পর জানানো হল মৃত্য সংবাদ। শাঁওলি মিত্রের প্রয়াণের খবরে শোকস্তব্ধ বাংলা নাট্য জগৎ। বাক্যহারা তাঁর অগণিত গুণমুগ্ধ। রবিবার বিকেল ৩টে ৪০ মিনিটে প্রয়াত হন তিনি। সিরিটি শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় এদিন রাতেই। শাঁওলি মিত্র একটি ইচ্ছাপত্র তৈরি করেছিলেন। সেখানেই তিনি জানিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর খবর শেষকৃত্যের পর যেন সকলকে জানানো হয়। সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর প্রিয়জনেরা।শাঁওলি মিত্রর বাবা শম্ভু মিত্রও একই ধরনের ইচ্ছাপত্র করে গিয়েছিলেন।প্রসঙ্গত শম্ভু মিত্রের মৃত্যু হয়েছিল ১৯৯৭ সালে।
শাঁওলি মিত্র প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কন্যা। শম্ভু মিত্রও একই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনিও চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব তাঁর শেষকৃত্য যেন সম্পন্ন হয়। অন্ত্যেষ্টির পর যেন সকলকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়। একই ইচ্ছা প্রকাশ করেন শাঁওলি মিত্রও।
ইচ্ছাপত্রে শাঁওলি মিত্র লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর মানস কন্যা অর্পিতা ঘোষ ও পুত্রতূ্ল্য সায়ক চক্রবর্তী শেষকৃত্যের সমস্ত ব্যবস্থা করবেন। একইসঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর কোনও ফুলভার যেন তাঁকে বইতে না হয়। সকলের অগোচরে যেন অন্ত্যেষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সেই ইচ্ছাকেই সম্মান জানান তাঁর স্বজনেরা।
তিনি নিজে একজন বিশিষ্ট নাট্য-ব্যক্তিত্ব। পঞ্চম বৈদিক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নাটকে অভিনয় শুরু করেন মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর বয়স থেকে। শিশু-শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন বহুরূপী প্রোডাকশনের তুলসী লাহিড়ির “ছেঁড়া তার”-এর বশিরের ভূমিকায় ও “ডাকঘর”-এ অমলের ভূমিকায়।
অভিনয় করেছেন ঋত্বিক ঘটকের “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো” ছায়াছবিতে।
তাঁর ১৯৮৩ সালে রচিত এবং অভিনীত নাটক “নাথবতী অনাথবৎ”, বাংলা নাটকের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে পড়ে। তাঁর নির্দেশিত অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে “কথা অমৃতসমান”, “বিতত বিতংস”, “পুতুল খেলা”, “রাজনৈতিক হত্যা”, “চণ্ডালী” প্রভৃতি।
১৯৯১ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন “নাথবতী অনাথবৎ”-এর জন্য। সে বছরই পান শিরোমণি পুরস্কার এশিয়ান পেইন্টস এর তরফ থেকে। ২০০৩ সালে ভূষিত হন সংগীত নাটক অ্যাকাদেমি পুরস্কারে। ২০০৬ সালে ভূষিত হন নরওয়ের সংস্কৃতি মন্ত্রকের “দ্য ইবসেন সেন্টেনিয়াল এওয়ার্ড”-এ। ২০০৯ সালে কবি ভারত সরকার দ্বারা পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন।
সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে যে ক’জন বুদ্ধিজীবি সর্বাগ্রে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখ খুলেছিলেন, শাঁওলি মিত্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
পশ্চিমবঙ্গের সরকার তাঁকে “বঙ্গ বিভূষণ”(২০১২)সম্মানে ভূষিত করেন। এ ছাড়া সেই সরকার তাঁকে বিভিন্ন সরকারী কর্মকাণ্ডের পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত করেন।
অভিনীত নাটক
বিতত বীতংস
নাথাবতী আনাথবৎ, পুতুলখেলা
একটি রাজনৈতিক হত্যা, হযবরল
কথা অমৃতসমান, লঙ্কাদহন
চণ্ডালী, পাগলা ঘোড়া
পাখি, গ্যালিলিও’র জীবন
ডাকঘর, যদি আর এক বার প্রভৃতি।
তাঁর মৃত্যুতে মুখ্যমন্ত্রী শোকবার্তায় লেখেন,”বাংলা নাট্যজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং প্রখ্যাত মঞ্চশিল্পী শাঁওলি মিত্রের প্রয়াণে আমি গভীর ভাবে শোকাভিভূত বোধ করছি।
প্রবাদপ্রতিম শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কন্যা শাঁওলি মিত্র বাংলা অভিনয় জগতে মহীরুহ ছিলেন। ‘নাথবতী অনাথবৎ’ বা ‘কথা অমৃতসমান’ এর মতো সৃষ্টিকর্ম বাংলার লোকমানসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শাঁওলি মিত্র আমার বহুদিনের সহযোগী ছিলেন। সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তিনি আমার সঙ্গে একসাথে ছিলেন। আমি রেলমন্ত্রী থাকার সময় তিনি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। পরে আমরা দায়িত্বে এলে কিছুদিন পর তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি হন এবং দায়িত্বের সঙ্গে মূল্যবান কাজ করেন। বাংলার সরকার তাঁকে ২০১২ সালে বঙ্গবিভূষণ ও ২০১৪ সালে দীনবন্ধু পুরস্কার দেয়।
শাঁওলিদির ইচ্ছাক্রমে তাঁর প্রয়াণের খবর আমাকে শেষকৃত্যের পর দেওয়া হয় ।আমি কিন্তু কাছের মানুষ হিসাবে তাঁকে মনে ধরে রাখলাম। আমাদের বহুদিনের সহকর্মী এবং সুহৃদ হিসেবে তিনি আমাদের মনের মণিকোঠায় থেকে যাবেন।
আমি শাঁওলিদির পরিবার- পরিজন ও অগণিত গুণগ্রাহী কে আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”