নিজস্ব প্রতিনিধি: এই বছর শ্যাম সুন্দর ইস্কুলে বায়োস্কোপ-এর বিষয় হল ‘ছোটোদের সৌমিত্র’। তাঁরই অভিনীত ছ’টি শিশু চলচ্চিত্রের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে সদ্য-প্রয়াত চলচ্চিত্র ও মঞ্চ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ। অতিমারীর জন্য ইস্কুলে ইস্কুলে গিয়ে ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘কনি’, ‘পাতালঘর’ ও ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ না-দেখানো গেলেও, অনলাইন মাধ্যমে সেগুলি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আলোচনা করার জন্য সরাসরি উপস্থিত থাকবেন শর্মিলা ঠাকুর, গৌতম ঘোষ, অতনু ঘোষ,রূপক সাহা ও সিদ্ধা্র্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। আর থাকছে ২০টি ইস্কুলের দশ হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা ছাড়াও থাকবে তাঁর অভিনীত ছোটোদের চলচ্চিত্রগুলির ওপর কিছু প্রতিযোগিতামূলক ও সৃজনশীল কাজকর্ম, যেগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে। বিজয়ীদের সবাইকে ইস্কুলে বায়োস্কোপ-এর পক্ষ থেকে শংসাপত্রও দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানটি চলবে ১৮ই জুন থেকে ১৫ই জুলাই, ২০২১ পর্যন্ত। বিদেশের বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীরাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকবেন পৌলমী বসু, অতনু ঘোষ,অমিতাভ নাগ,রূপক সাহা ( কর্নধার,শ্যাম সুন্দর কোম্পানি জুয়েলার্স), সঞ্চালনায় থাকবেন এস.ভি.রামন,১৮ জুন,বিকেল ৫টা,ইস্কুলে বায়োস্কোপ ফেসবুক পেজ থেকে।এবছর সমগ্র অনুষ্ঠানটি নিবেদন করছেন শ্যাম সুন্দর কোম্পানি জুয়েলার্স।
“আজ থেকে কুড়ি বছর পর বাংলা সিনেমার দর্শক থাকবে তো?” এই অদ্ভুত প্রশ্নটিই সেই ২০১৬ থেকে কুরে কুরে খেয়ে চলেছে বেঙ্গালুরু-নিবাসী বাঙালী কৌশিক চক্রবর্তীকে। তাঁর কথায়, এটি নিছক প্রশ্ন নয়, বরং ভয় বলা যেতে পারে। সত্যিই তো; ভয় হওয়ার মতোই বিষয় এটি। কিন্তু ক’জনই বা ভাবেন এসব নিয়ে? ক’জনের মধ্যেই বা নিজের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থাকে? হ্যাঁ, হাতে গোনা কিছু মানুষের মধ্যেই থাকে। এবং তাঁদের মধ্যে একজন হলেন গিয়ে এই কৌশিকবাবু।
২০১৬’র শুরুর দিকের একটি ঘটনা। কাজের ফাঁকে বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় এসেছিলেন কৌশিকবাবু। বাড়ির কাছেই সিটি সেন্টার ওয়ান। এক রবিবার বিকেলে হাঁটতে হাঁটতেই চলে গেলেন সেখানে। গিয়ে দেখলেন যে, সেখানকার মাল্টিপ্লেক্সের বক্স অফিসের সামনে এক বাবা-মা তাঁদের ছোট্ট মেয়েকে একটি বাংলা সিনেমা দেখানোর প্রবল চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সেই ছোট্ট মেয়েটি কিছুতেই বাংলা সিনেমা দেখবে না। হিন্দী বা ইংরেজী সিনেমা দেখবে। কৌশিকবাবু সেই ছোট্ট মেয়েটির কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল যে, সে কেন বাংলা সিনেমা দেখতে চাইছে না। মেয়েটি বলে যে, বাংলা সিনেমা দেখেছে শুনলে পরদিন ওর স্কুলের বন্ধুরা ওকে খ্যাপাবে।
সেদিন রাত্রিবেলা কৌশিকবাবুর ঠিক মতো ঘুম হয়নি। বার বার সেই ছোট্ট মেয়েটির কথাগুলি তাঁর কানের কাছে ভেসে আসছিল। ভাবছিলেন, এই যদি অবস্থা হয়, আগামী দিনে তো বাংলা সিনেমার কোনো দর্শকই থাকবে না। আর দর্শক না-থাকলে কোনো প্রযোজক পয়সা খরচ করে বাংলা সিনেমা বানাবেনই বা কেন। তার মানে কি বাংলা সিনেমা বন্ধ হয়ে যাবে ? ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋতুপর্ণ… সব বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে যাবে ? শুধুমাত্র দর্শকের অভাবে ? না, এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। বাংলা সিনেমাকে এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে দেওয়া যায় না। দর্শক নেই তো কী হয়েছে, দর্শক তৈরী করতে হবে। আগামী প্রজন্মকে বেশি করে বাংলা সিনেমা দেখাতে হবে; বাংলা সিনেমা কী, সেটা তাদের বোঝাতে হবে; বাংলা সিনেমার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতে হবে।
সেবার বেঙ্গালুরুতে ফিরে গিয়েই কৌশিকবাবু ভাবতে শুরু করলেন, কী করে বাংলা সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, আগামী প্রজন্মের কাছে কী ভাবে বাংলা সিনেমাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। “বাংলা সিনেমার জন্য কিছু একটা না করতে পারলে যেন স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই, একটা ব্লু-প্রিন্ট তৈরী করলাম। ইস্কুল পর্যায়ে শিক্ষা ও সিনেমার মেলবন্ধনই ছিল সেই ব্লু-প্রিন্টের মূল বিষয়। যোগাযোগ করতে শুরু করলাম শিক্ষা ও সিনেমার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে। শেষমেশ অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার চৌধুরীর সাহায্যে পৌঁছলাম
চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (সিএফএসআই)-র দরবারে। গৃহীত হল প্রস্তাব, আর কাজও শুরু হল। প্রথম বছর অবশ্য নাম ছিল ‘সিএফএসআই বেঙ্গলি চিলড্রেনস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’; অনুষ্ঠিত হয়েছিল হেয়ার, হিন্দু, লোরেটো, লা-মার্টিনিয়ার, স্কটিশ চার্চ-সহ কলকাতার ২০টি নাম করা ইস্কুলে।” – কৌশিকবাবু বললেন।
ইস্কুলে বায়োস্কোপ-এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ থেকে। বস্তুত তার আগে বাংলা সিনেমাকে নিয়ে এই ধরনের শিক্ষা-বিনোদনমুলক অনুষ্ঠান আগে কখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রতি বছর ২০ থেকে ২৫টি স্কুলে গিয়ে সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো বাংলা সিনেমা দেখানো হয়। কখনও সত্যজিৎ রায়, কখনও সন্দীপ রায়, কখনও ঋতুপর্ণ ঘোষ, কখনও তপন সিংহ, কখনও নীতিশ রায়, কখনও আবার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের বানানো সিনেমা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মনোরঞ্জন করানো হয়। প্রতিটি ইন-স্কুল স্ক্রিনিং-এর সঙ্গে থাকে লাইভ ইন্টারঅ্যাকশান, লাইভ কুইজ, রিভিউ রাইটিং কম্পিটিশান, পোস্টার ডিজাইনিং কম্পিটিশান ও আরও অনেক কিছু। সব শেষে, সফল ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার ও শংসাপত্র দেওয়া হয়ে থাকে।
কৌশিকবাবু আরও বললেন, “ইতিমধ্যে আমরা একশোটির কাছাকাছি ইস্কুলের প্রায় এক লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর কাছে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছি। এবং আমরা কথা বলে দেখেছি যে, ওই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সচরাচর বাংলা সিনেমা দেখা হয়ে ওঠে না। আমরা কিন্তু ওই ছাত্র-ছাত্রী, তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বাবা-মায়েদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি, এবং সারা বছরই ইস্কুলগুলোর মাধ্যমে তাদের বাংলা সিনেমা সংক্রান্ত কিছু না কিছু কাজ করতে বলছি। এর ফলে তারা মাঝেমধ্যেই নতুন নতুন বাংলা সিনেমা দেখছে, সেগুলো উপভোগ করছে, এবং যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে কাজগুলো করে তাদের ইস্কুলে জমা দিচ্ছে। নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখা ও সেগুলো নিয়ে চর্চা করার একটা অভ্যাস তাদের মধ্যে তৈরী হচ্ছে। এই অভ্যাসকে ধরে রাখতে যদি আমরা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা ও অভিভাবকরা সবসময় তাদের পাশে থাকি, আগামী দিনে এরাই হয়ে উঠবে বাংলা সিনেমার একনিষ্ঠ দর্শক।”
রূপক সাহা,কর্ণধার, শ্যাম সুন্দর কোম্পানি জুয়েলার্স, বললেন,” এই সুন্দর উদ্যোগে আমরা অংশগ্রহণ করতে পেরে খুবই আনন্দিত।এরম ভাবনায় এক অভিনবত্ব আছে।আশা করি সকলের এই উদ্যোগ ভালো লাগবে।”