✍️প্রিয়রঞ্জন কাঁড়ার
আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করলো ঢুলুবাবু ওরফে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের মাস্টারপিস ‘ধন্যি মেয়ে’। বহুস্তরীয় আবেদনের পথ ধরে একটি জাতিসত্তার চিরন্তন ভাবাবেগের দ্বীপে একটা সাধারণ বাণিজ্যিক কমেডি ছবির এমন স্থায়ী নাগরিকত্ব লাভের দৃষ্টান্ত বিরল।
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সান্নিধ্যে বড় হয়ে ওঠা ঢুলুবাবু নাট্যজগতে পদার্পণ করেছিলেন ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের অনুপ্রেরণায়। চলচ্চিত্রের অমোঘ টানে অবলীলায় ছেড়েছিলেন চিকিৎসকের নিশ্চিন্ত পেশা। ঢুলুবাবুর প্রথম ছবি ‘কিছুক্ষণ’-এ ডেবিউ করেন অভিনেতা রবি ঘোষও। ঢুলুবাবুর সম্পাদিত ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকায় ছয়ের দশকের শেষ দিকে প্রকাশিত হয় দেবাংশু মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘লাউড স্পিকার’। ছোটগল্পের সেই চারাটি নতুন নতুন চরিত্র ও ঘটনার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ১৯৭১ সালে আজকের দিনে পর্দায় আবির্ভূত হয় ‘ধন্যি মেয়ে’ রূপে। এর আগের বছরই তাঁর ‘নিশিপদ্ম’ও সুপার-ডুপার হিট।
কমিক সংলাপের সাধারণ অসংগতির ক্ষুদ্র পরিসরগুলোকে ব্যবহার করে সমাজ ও ব্যক্তি-চরিত্রের দ্বিচারিতা ও পদস্খলনকে এমন নিখুঁত মাত্রাজ্ঞানের সঙ্গে বুনতে সচরাচর দেখা যায় না। ফুটবল মাঠে তোতলা ভট্টাচার্যের তিড়িং-বিড়িং লাফালাফির স্ল্যাপস্টিক শুধুমাত্র বহিরঙ্গ। আর্থিক অনটনের তীব্র দহনে তোতলা ভট্টাচার্যের শুকনো অন্তরমহলে জমে ওঠা নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা আসলে ডার্ক কমেডির সর্বোচ্চ পর্যায়। বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন সংক্রান্ত আলাপচারিতায় পাত্রীর বাবার জমির পরিমাণ জানতে চেয়ে কালী দত্তও নিজের আভিজাত্যের যাবতীয় বর্ম ছেড়ে মধ্যবিত্ত-সুলভ নগ্নতায় ধরা দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, এই ছবির পরতে পরতে মিশে গিয়েছে বাঙালি সমাজ-জীবনের সব রকমের তিক্ত অভিঘাত। ‘মনসা’ চরিত্রটি সেই যন্ত্রণার সাগর থেকে উঠে এসে সুখের ঘরে ফেরার একটা ইউটোপিয়ান ফ্যান্টাসি। ক্যামিও পার্শ্বচরিত্র গ্রাম্য চাওয়ালার লিপে ছবির গুরুত্বপূর্ণ গান দেওয়া পরিচালকের আর একটা মাস্টারস্ট্রোক।
জয়া ভাদুড়ি এই ছবির সবচেয়ে বড়ো পিলার। মনসার চরিত্রটি কিন্তু প্রথমে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কে অফার করা হয়। বলিউডে প্রবল ব্যস্ত মৌসুমীর ডেট না মেলায় ঢুলুবাবু জয়াকে নির্বাচন করেন। সত্যজিতের ‘মহানগর’ ছবিতে ক্যামিও রোল করা জয়া ছিলেন ঢুলুবাবুর দাদা সাহিত্যিক বনফুলের ঘনিষ্ঠ তরুণ ভাদুড়ির মেয়ে। পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের কলকাতায় আয়োজিত প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় অতিথি পরীক্ষক হিসেবে উপস্থিত ঢুলুবাবু স্বচক্ষে জয়ার প্রতিভা জরিপ করে নিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস।
কালী দত্তের চরিত্রেও প্রথমে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ছবির চিত্রনাট্য শুনে উত্তমকুমার স্বয়ং এই চরিত্রটি ঢুলুবাবুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন। আসলে ‘ছোটি সি মুলাকাত’ বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার পর উত্তমকুমারের কেরিয়ারেও একটা বড়সড় মোড় জরুরি হয়ে পড়েছিল। রোম্যান্টিক নায়কের ইমেজ ভেঙে চরিত্রাভিনেতা উত্তমের জার্নিও শুরু হয়েছিল এই ছবি থেকেই।