আনন্দ সংবাদ লাইভ: সমগ্র ভারতব্যাপী ভার্চুয়ালি আয়োজিত “উইনিং চ্যালেঞ্জেস” শীর্ষক ওয়েবিনারে মূক-বধির ইঞ্জিনিয়ার তথা প্রেরণাদায়ী বক্তা বৈভব কোঠারী সরকারের কাছে আবেদন জানান দেশের অগণিত মূক-বধির নাগরিকদের কল্যানে তৎপর হতে এবং ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ অর্থাৎ সাংকেতিক ভাষাকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভার্চুয়ালি এই ওয়েবিনারে যোগদান করা অসংখ্য দর্শকদের কাছে বৈভবের কথোপকথন উপস্থাপিত হয় দোভাষীর মাধ্যমে।
ওয়েবিনারে প্রশ্নকর্তার ভূমিকায় ছিলেন কলকাতার অধিবাসী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক তথা লেখক সন্দীপ ভূতোড়িয়া। “ভারতের ২২টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষার মধ্যে ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ সংযুক্ত হওয়া উচিত” কিনা সেই প্রসঙ্গে বৈভব তাঁর উপরিউক্ত আবেদন জানান।
“সংবিধান স্বীকৃত ২২টি ভাষার মধ্যে অন্যতম হল, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃত। সরকার এই প্রাচীণ ভাষার সংরক্ষণ ও চর্চা বজায় রাখার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। তালিকাভুক্ত ভাষার মধ্যে নবউদ্ভুত আই.এস.এল (ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ) এর সংযোজন যথেষ্ট প্রয়োজনীয়। এর মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মূক-বধির শিক্ষার্থী যারা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী তাদের স্বপ্নপূরণ হবে” জানান সুবক্তা বৈভব।
সাংকেতিক ভাষার আলাদা ব্যাকরণ এমনকি পৃথক শব্দকোষও রয়েছে। আদমসুমারী অনুযায়ী মূক ও বধির অধিবাসীর জনসংখ্যার নিরীখে ভারত প্রথম সারিতে রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের দেশে সংবিধান স্বীকৃত কোনো সাংকেতিক ভাষার অস্তিত্ব নেই।
বৈভব কোঠারীর বায়োগ্রাফির সারবত্তা হল সাধারণের থেকেও অপরিণত একটি ছেলের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে প্রশিক্ষণলাভের পরে এমবিএ ও ইঞ্জিনিয়ারিং এও ডিগ্রীলাভ করেন তাঁর দুর্দম প্রত্যয় ও অধ্যাবসায়ের ফলস্বরূপ। অন্যদিকে এই মেধাবী ছাত্র শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করার পর পারিবারিক ব্যবসা ওম মেটালস ইনফ্রা প্রোজেক্টস এন্ড ওম ইন্টারন্যাশনাল এলএলসি-র কর্ণধার হন বৈভব। তিনি অনুপ্রেরণামূলক টক শো ‘ওএমভিএআই’ এর উদ্যোক্তা। এছাড়াও মোটিভেশনাল স্পিকার হিসাবে বৈভব শতসহস্র প্রতিবন্ধীদের উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে খুবই সচেষ্ট। বধির মানুষের জীবনের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব নিয়ে বৈভব একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
এক সংকটময় সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেই যে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার চাবিকাঠি লুকিয়ে থাকে বৈভব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বহু দুর্গম চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যুদ্ধ করার যে সংকল্প, সহনশীলতা, জীবনের প্রতি ভক্তি সর্বোপরি সাফল্য বৈভব কোঠারীকে এক দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
“আমি বৈভবের সম্পর্কে সবিস্তারে জানার পর ব্যাক্তিগতভাবে তাঁর সাক্ষাতকার নিতে আগ্রহী ছিলাম। শুধুমাত্র ভারতীয়দের কাছেই নয় সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছেই বৈভবের জীবন যাত্রা শিক্ষণীয়। কিভাবে চূড়ান্ত প্রতিকূলতার সাথে সংগ্রাম করেও লক্ষ্যস্থির রাখতে হয় তা শিখিয়েছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা। বিশেষত বিশ্বমহামারীর এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে বৈভবের জীবন সকলকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে, বলেন শ্রী সন্দীপ ভূতোড়িয়া।
করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ফলে শ্রবণশক্তিহীন সম্প্রদায় চূড়ান্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন সতর্কীকরণ, বিজ্ঞপ্তি, হেল্পলাইন নম্বর সম্পর্কে তারা অবহিত হতে পারছেন না। অনলাইন মাধ্যমে নতুন শিক্ষাপদ্ধতির ক্ষেত্রেও বধির ছাত্রছাত্রীরা শ্রবণশক্তি না থাকায় ঠিকমত ক্লাস করতে পারছেনা, কারণ বধির শিক্ষার্থীদের সকল অভিভাবকরা সাংকেতিক ভাষায় সাবলীল নন। নতুন শিক্ষানীতিতে আইএসএল অফিশিয়াল ভাষার স্বীকৃতি পাওয়া আবশ্যিক। ওয়েবিনারের প্রশ্নকর্তা শ্রী ভূতোড়িয়ার কথাতেও বৈভবের আবেদনের প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
খুবই সীমিত সংখ্যক দোভাষী ও অনুবাদক থাকার ফলে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি কলেজের কাছে বধির শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো রয়েছে। কিন্তু খুবই ব্যায়সাধ্য হওয়ার কারণে স্বল্পসংখ্যক বধির শিক্ষার্থী তাদের স্বপ্নপূরণের সুযোগ পায়। ১৯৯৫ সালের ‘পারসনস উইথ ডিসএবিলিটি অ্যাক্ট’ অনুসারে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ১% পদ প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত। তবে এই কর্মপদে নিযুক্ত হওয়ার কয়েকটি শর্তাবলী রয়েছে যেমন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রী থাকা বাধ্যতামূলক।
২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী ভারতে বধির জনজাতির সংখ্যা ১.৩ মিলিয়ন। তবে ইন্ডিয়া’স ন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েসন এর পরিসংখ্যান অনুসারে প্রায় ১৮ মিলিয়ন অর্থাৎ সমগ্র জনসংখ্যার ১% শ্রবণশক্তিহীন। ২০১৫ সালে দিল্লীতে ভারত সরকার ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার গঠন করে। ২০১৮ সালে প্রথম ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গোয়েজের অভিধান প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩০টি সাংকেতিক ভাষা রয়েছে যার মধ্যে ভারতেরও নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা বর্তমান।
কলকাতার সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক উদ্যোগপতি, লেখক, কলামনিস্ট, ব্লগার সন্দীপ ভূতোড়িয়ার উদ্যোগে ও সক্রিয় পদক্ষেপে সরকারী সহায়তায় কিছু নীতি পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন, অপারগ অভিভাবকদের শিশুদের পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার অসুবিধা বা নতুন অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতি কিন্ডারগার্টেনের শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক না করা। ভারতের অগণিত লোকশিল্পীরা বিশ্বমহামারীর কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ায় যে নিদারুণ সংকটে রয়েছে তাদের জন্য সাহায্যের আবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রকে চিঠি লেখেন এবং অতি সত্ত্বর সরকারের পক্ষ থেকে দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়।