নিজস্ব প্রতিনিধি : তখন বাংলার মসনদে বসে আছেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। কাজী চাঁদের মাধ্যমে হুকুম জারি করলেন , মায়াপুর সহ গোটা নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তন বন্ধ করার। চারিদিকে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় মাৎসন্যায়ের পরিস্থিতি চলছে। নিপীড়িত মানুষ ঈশ্বরকে আহ্বান করছেন এই পরিস্থিতি দূর করার জন্য মাটির পৃথিবীতে অবতরণ করতে। ঠিক এই সময়ই তিনি জন্মগ্রহণ করলেন শ্রীধাম মায়াপুরের মাটিতে। ঠিক আজ থেকে ৫৩৬ বছর আগে জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবীর কোলে পিতৃদত্ত নাম বিশ্বম্ভর, আমরা চিনি শ্রীচৈতন্য নামে।
বিশ্বম্ভর থেকে মহাপ্রভু হয়ে উঠতে শ্রীচৈতন্যকে অনেকটা দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। আর যে অমৃতনাম তিনি কলির জীবকে দান করলেন তা হয়ে রইল অনন্তকালের সাধকদের পরমপ্রিয় পাথেয়। তা হল হরিনাম। শুধু তাই নয় , ভারতবর্ষের নবজাগরণের প্রথম পথিকৃৎ যিনি শিল্প – সংস্কৃতি – চিন্তনেও ছাপ রেখে গেছেন। মহাপ্রভুর এই বর্ণময় জীবন , অজানা জীবন রহস্যে ঘেরা অপ্রকটলীলা নিয়ে মানুষের কৌতূহল অপরিসীম।
আর এই উদ্দেশ্যেই বাগবাজার গৌড়ীয় মিশন (প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদ) ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রথম শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছে। উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩ সালে শিলান্যাস করেছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে নির্মাণকার্য্য দেখে গেছেন দুষ্প্রাপ্য সামগ্রে ভরা এই ঐতিহাসিক সংগ্রহালয়ের। যা মহাপ্রভুর জীবনসহ গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন , বাংলা সংস্কৃতির একটি প্রামাণ্য দলিল।
এই সংগ্রহশালায় রয়েছে মহাপ্রভুর পাদুকা , মহাপ্রভুর বাড়ির সিংহাসন , মহাপ্রভুর নিজের হাতে লেখা পুঁথি সহ অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ। এছাড়াও ডায়োরেমা , লাইট এন্ড সাউণ্ড শো , ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, তথ্যচিত্র , সার্কারিনার মাধ্যমে মহাপ্রভুর জীবন , অবদান এবং অন্যান্য বৈষ্ণব মহাজনদের শিক্ষাকে প্রদর্শিত করা হয়েছে।
এই মিউজিয়ামের কিউরেটর প্রীতম বাগচী অত্যন্ত যত্ন সহকারে মিউজিয়ামটিকে রক্ষণাবেক্ষন করে চলেছেন। তিনি একাধারে লক্ষৌ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন দক্ষ কনজারভেটর। দুষ্প্রাপ্য জিনিসকে কেমিক্যাল এবং নন কেমিক্যালি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন – “বেশীরভাগ জিনিসই অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় প্রাথমিক ভাবে প্রথমে দেখে নিতে হয় সেটিতে কেমিক্যাল প্রয়োগ করা যাবে কিনা , এবং করলেও সেটি যেন তার অরিজিনালিটি না হারায় সেদিকেও নজর দিতে হয়। পুরো প্রসেসটি হাতেই করা হয় যার জন্য আমরা একটি কনজারভেশন ল্যাবরেটরি তৈরী করেছি। এছাড়াও মিউজিয়ামের সার্বিক দিকে লক্ষ্য রাখাটাও অত্যন্ত জরুরী। এইজন্য সরকারের সাহায্য প্রার্থনা করছি। মিউজিয়ামটিকে কীভাবে জনসাধারণের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলা যায় তা নিয়ে ভক্তিনিষ্ঠ মধুসূদন মহারাজের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনা করি। আমাদের ইচ্ছা মিউজিয়ামটিকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার “
প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিৎ, প্রীতম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী মিউজিয়ামের আরেক কৃতবিদ্য কিউরেটর ড. বৈশাখী মিত্রের সুযোগ্য ছাত্র এবং প্রীতম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
বাগবাজারের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মিউজিয়ামের টিকিটের মূল্য ১২০ টাকা ছিল কিন্তু শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী প্রভুপাদের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সীমিত সময়ের জন্য ৫০% ছাড়ে অর্থাৎ ৬০ টাকায় জনসাধারণের জন্য প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে। গাইড সার্ভিস ফ্রী। এই মিউজিয়াম সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খোলা এবং বিকেল ৩ টে থেকে ৭ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। অনুসন্ধিৎসু ভিজিটররা বিশেষ কিছু জানতে চাইলে কিউরেটরের সঙ্গে সাক্ষাৎও নির্দ্বিধায় করতে পারেন।