By Ramiz Ali Ahmed
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যাঁর নামটাই যথেষ্ট আপামর বাঙালির হৃদয় উদ্বেলিত করতে।শ্রদ্বায় মাথা নত হয় আট থেকে আশির।যার ছবি কখনও কখনই পুরোনো হয় না দর্শক হৃদয়ে।সেই লেজেন্ড আজ নেই এটা ভাবতেই পারছে না বাঙালি।বাঙালির মন আজ দুঃখে মন ভারাক্রান্ত।দীর্ঘ ৬০ বছরের ওপর অভিনয় জীবন। অভিনয় করেছেন ৩০০-র উপর ছবিতে।তিন দশকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্ম।জন্ম নদিয়ার কৃষ্ণনগরে।মঞ্চে ও পর্দা-দুটো মাধ্যমেই তিনি নিয়মিত কাজ করেছেন।কাজ করেছেন টিভি ধারাবাহিকেও।তিনি একজন খুব উচুদরের আবৃত্তিকার।কবিতাচর্চা,রবীন্দ্রপাঠ,
সম্পাদনা,নাট্যসংগঠন তাঁর বিপুল বৈচিত্র্যের এক একটি দিক।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সব কিছু নিয়েই অনন্য।বয়স কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয়,আগামী বহু প্রজন্মের অভিনেতাদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা।
তাঁর আদিবাড়ি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে।বাবা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, মা আশালতা দেবী।চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি বাড়ি ছিল এখনকার বাংলাদেশের শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহের আমল থেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন।সৌমিত্রর বাবা পেশায় ছিলেন আইনজীবী।কিন্তু বাবার নাটক ও কবিতার প্রতি ছিল ভালোবাসা।বাবার বদলির চাকরি।বাবার বদলির চাকরির কারণে সৌমিত্রর বহু স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল।পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জেমস কলেজিয়েট স্কুল থেকে।এরপর বারাসাত গভর্নমেন্ট হাই স্কুল,হাওড়া জেলা স্কুল,দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাই স্কুল,কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল শেষে ১৯৫১ তে হাওড়া জেলা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন।১৯৫৩ তে কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজ থেকে আই এস সি তারপর ওখান থেকেই বাংলায় অনার্স নিয়ে স্নাতক।স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।যদিও স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করা আর সম্বব হয়ে ওঠেনি।কলেজে পড়ার সময় ‘কবয়’ ও ‘রামমোহন’ নাটকে অভিনয় করে তিনি সকলের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময় হঠাতই একদিন মঞ্চে শিশির কুমার ভাদুড়ির নাটক দেখার সুযোগ হয়।জীবনের মোড় ঘুরে যায় সে দিনই।ইতিমধ্যে শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হয়।পুরোদস্তুর নাটকে মনোনিবেশ করেন তিনি।তাঁর থিয়েটার কেরিয়ারে চিরকাল তিনি শিশির ভাদুড়িকে গুরুর মান্যতা দিয়ে এসেছেন।অদ্ভূত এক বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের মধ্যে।১৯৫৭ সালে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে ‘প্রফুল্ল’ নাটকে যোগেশের ভূমিকায় শিশির কুমার ভাদুড়ি ও সুরেশের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।শিশির কুমার ভাদুড়ির কাছে যাঁর শিক্ষানবিশ শুরু হয়েছিল,তাঁর মজ্জার মধ্যে কোথাও নিষিক্ত হয়েছিল মঞ্চের প্রতি এক সম্মোহ,ফলে পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে অসামান্য সাফল্যও তাঁকে মঞ্চের প্রতি উদাসীন হতে দেয়নি।বারে বারে ফিরে এসেছেন মঞ্চে।বারেবারেই চেষ্টা করেছেন মুখে রং মেখে সাজপোশাক পরে জলজ্যান্ত দর্শকদের সামনে দাঁড়াবার,তাদের হাততালি বা নৈঃশব্দের ভিন্নতর এক ঘনিষ্ঠ আস্বাদন নেবার।
অভিনেতা নয়,অল ইন্ডিয়া রেডিও-র ঘোষক হিসেবেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পেশাগত জীবন শুরু বলা যায়।১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত আকাশবাণীর ঘোষক ছিলেন।
১৯৫৬ সালে যখন সত্যজিৎ রায় ‘অপরাজিত’-র জন্য নতুন মুখের সন্ধান করছিলেন,তখনই প্রথম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আলাপ হয়েছিল কিংবদন্তি পরিচালকের।তখন বছর ২০ বছর বয়স হবে অভিনেতার,সদ্য কলেজ পাশ করেছেন।সৌমিত্রকে দেখে অপু হিসেবে পছন্দও হয়ে গিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের কিন্তু শেষ পর্যন্ত সৌমিত্রর কাস্টিং নাকচ করেন তিনি।’অপরাজিত’-র অপু চরিত্রে শেষ পর্যন্ত তাঁর আর অভিনয় করা হয়নি।তার প্রায় দুবছর পরে সালটা ১৯৫৮ সত্যজিৎ রায় যখন ‘জলসঘর’-এর শুটিং-এ ব্যস্ত।সৌমিত্র গিয়েছেন ‘জলসঘর’ ছবির শুটিং দেখতে।সেট ছেড়ে বেরোবেন,এমন সময়েই ডাক পড়ে তাঁর।ডাকেন স্বয়ং ‘রে’।এরপর যা হয় তার জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন না সৌমিত্র নিজেও।বাংলা সিনেমা জগতের আর এক কিংবদন্তি ছবি বিশ্বাসের কাছে সৌমিত্রকে সত্যজিৎ পরিচয় করান অনেকটা এই ভাবে,”এই হল সৌমিত্র।আমার পরবর্তী ছবি ‘অপুর সংসারে’ ও অপু করছে।”বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অভিনেতা কারণ তিনি সেই প্রথম জানতে পারেন যে মনে মনে কাস্টিংটা ঠিক করে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়।তারপরের অধ্যায়টা তো ইতিহাস।’অপুর সংসার’-এর মতো কালজয়ী এক সিনেমার মাধ্যমে সিনেমার জগতে হাতেখড়ি হয় সৌমিত্রর।প্রথম ছবিতেই বাজিমাত।ফার্স্ট শটেই সিন ওকে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
১৯৫৯-অপুর সংসার- সত্যজিৎ রায়
১৯৬০ ক্ষুধিত পাষাণ – তপন সিংহ
১৯৬০ দেবী – সত্যজিৎ রায়
১৯৬১ স্বরলিপি – অসিত সেন
১৯৬১ তিনকন্যা (সমাপ্তি) – সত্যজিৎ রায়
১৯৬১ স্বয়ম্বরা – অসিত সেন
১৯৬১ পুনশ্চ – মৃণাল সেন
১৯৬১ ঝিন্দের বন্দি- তপন সিংহ
১৯৬২ শাস্তি – দয়াভাই
১৯৬২ অতল জলের আহ্বান – অজয় কর
১৯৬২ আগুন – অসিত সেন
১৯৬২ বেনারসী – অরূপ গুহঠাকুরতা
১৯৬২ অভিযান -সত্যজিৎ রায়
১৯৬৩ সাত পাকে বাঁধা- অজয় কর
১৯৬৩ শেষ প্রহর – প্রান্তিক
১৯৬৩ বর্ণালী – অজয় কর
১৯৬৪ প্রতিনিধি – মৃণাল সেন
১৯৬৪ চারুলতা -সত্যজিৎ রায়
১৯৬৪ কিনু গোয়ালার গলি – ও সি গাঙ্গুলী
১৯৬৪ অয়নান্ত – সন্ধানী
১৯৬৫ বাক্স বদল – নিত্যানন্দ দত্ত
১৯৬৫ কাপুরুষ ও মহাপুরুষ(কাপুরুষ) – সত্যজিৎ রায়
১৯৬৫ একই অঙ্গে এত রূপ – হরিসাধন দাশগুপ্ত
১৯৬৫ একটুকু বাসা – তরুণ মজুমদার
১৯৬৫ আকাশ কুসুম-অজয় মৃণাল সেন
১৯৬৬ মনিহার – সলিল সেন
১৯৬৬ কাচ কাটা হীরে – অজয় কর
১৯৬৬ অঙ্গীকার – সুশীল ঘোষ
১৯৬৬ জোড়া দিঘির চৌধুরী পরিবার – অজিত লাহিড়ী
১৯৬৭ হঠাৎ দেখা – নিত্যানন্দ দত্ত
১৯৬৭ হাটে বাজারে – তপন সিংহ
১৯৬৭ প্রস্তর স্বাক্ষর – সলিল দত্ত
১৯৬৭ অজানা শপথ – সলিল সেন
১৯৬৭ মহাশ্বেতা – পিনাকি মুখোপাধ্যায়
১৯৬৮ পরিশোধ – অর্ধেন্দু সেন
১৯৬৮ বাঘিনী – বিজয় বসু
১৯৬৯ তিন ভুবনের পারে – আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়
১৯৬৯ পরিণীতা-অজয় কর
১৯৬৯ অপরিচিত – সলিল দত্ত
১৯৬৯ চেনা অচেনা – হীরেন নাগ
১৯৬৯ বালক গদাধর – হিরন্ময় সেন
১৯৭০ অরণ্যের দিনরাত্রি-সত্যজিৎ রায়
১৯৭০ আলেয়ার আলো – মঙ্গল চক্রবর্তী
১৯৭০ পদ্ম গোলাপ – অজিত লাহিড়ী
১৯৭০ প্রথম কদম ফুল – ইন্দর সেন
১৯৭১ মাল্যদান – -অজয় কর
১৯৭১ খুঁজে বেড়াই – সলিল দত্ত
১৯৭১ সংসার – সলিল সেন
১৯৭২ স্ত্রী – সলিল দত্ত
১৯৭২ জীবন সৈকতে – স্বদেশ সরকার
১৯৭২ অপর্ণা – সলিল সেন
১৯৭৩ নতুন দিনের আলো -অজিত গাঙ্গুলী
১৯৭৩ বসন্ত বিলাপ – দীনেন গুপ্ত
১৯৭৩ নিশিকন্যা – আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়
১৯৭৩ অশনি সংকেত – সত্যজিৎ রায়
১৯৭৩ রক্ত (বিলেত ফেরত ) – চিদানন্দ দাশগুপ্ত
১৯৭৩ শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন – সলিল দত্ত
১৯৭৩ অগ্নি ভ্রমর – অজিত গাঙ্গুলী
১৯৭৩ এপার অপার – আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়
১৯৭৪ সোনার কেল্লা -সত্যজিৎ রায়
১৯৭৪ সঙ্গিনী -দীনেন গুপ্ত
১৯৭৪ অসতী – সলিল দত্ত
১৯৭৪ যদি জানতেম – যাত্রিক
১৯৭৪ সংসার সীমান্তে – তরুণ মজুমদার
১৯৭৬ দত্তা – অজয় কর
১৯৭৬সুদূর নীহারিকা-সুশীল মুখোপাধ্যায়
১৯৭৬নন্দিতা-স্বদেশ সরকার
১৯৭৭বাবুমশাই-সলিল দত্ত
১৯৭৭মন্ত্রমুগ্ধ-অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়
১৯৭৭প্রতিমা-পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৭৮প্রণয় পাশা-মঙ্গল চক্রবর্তী
১৯৭৮ নদী থেকে সাগরে-অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়
১৯৭৯ জয় বাবা ফেলুনাথ-সত্যজিৎ রায়
১৯৭৯ নৌকাডুবি – অজয় কর
১৯৭৯ দেবদাস – দিলীপ রায়
১৯৭৯ গণদেবতা – তরুণ মজুমদার
১৯৭৯জব চর্নকের বিবি-জয়ন্ত ভট্টাচার্য
১৯৮০ হীরক রাজার দেশে-সত্যজিৎ রায়
১৯৮০ পঙ্খীরাজ-পীযুষ বসু
ঘরের বাইরে
১৯৮০দর্পচূর্ণ-দিলীপ রায়
১৯৮০ঘরের বাইরে ঘর-সলিল দত্ত
১৯৮১প্রতিশোধ-সুখেন দাস
১৯৮১ন্যায় অন্যায়-সুখেন দাস
১৯৮২ খেলার পুতুল -তরুণ মজুমদার
১৯৮২বিজয়িনী-পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮২রসময়ীর রসিকতা-অমল শুর
১৯৮২প্রেয়সী-শ্রীকান্ত গুহঠাকুরতা
১৯৮২মাটির স্বর্গ-বিজয় বসু
১৯৮৩চেনা অচেনা-পিনাকী চৌধুরী
১৯৮৩অগ্রদানী-পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮৩ইন্দিরা-দীনেন গুপ
১৯৮৪ অমর গীতি -তরুণ মজুমদার
১৯৮৪সীমান্ত রাগ-প্রদীপ ভট্টাচার্য
১৯৮৪লাল গোলাপ-জহর বিশ্বাস
১৯৮৫ঘরে বাইরে -সত্যজিৎ রায়
১৯৮৫বৈকুন্ঠের উইল-সুশীল মুখোপাধ্যায়
১৯৮৫টগরী-অজিত গঙ্গোপাধ্যায়
১৯৮৫সন্ধ্যা প্রদীপ-অঞ্জন মুখোপাধ্যায়
১৯৮৬-কোনি-সরোজ দে
১৯৮৬ শ্যাম সাহেব – সলিল দত্ত
উর্বশী-সলিল দত্ত
অচেনা মুখ-অজিত লাহিড়ী
বসুন্ধরা-শেখর চট্টোপাধ্যায়
আতঙ্ক-তপন সিংহ
১৯৮৭ ন্যায় অধিকার-অঞ্জন মুখোপাধ্যায়
১৯৮৮ছন্নছাড়া-অঞ্জন মুখোপাধ্যায়
অগ্নি সংকেত-অরূপ দত্ত
আগুন -ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮৯ গণশত্রু -সত্যজিৎ রায়
১৯৯০ শাখাপ্রশাখা-সত্যজিৎ রায়
১৯৯২ তাহাদের কথা – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
১৯৯২ মহাপৃথিবী – মৃনাল সেন
পথ ও প্রাসাদ-তরুণ মজুমদার
১৯৯৪ হুইল চেয়ার – তপন সিংহ
১৯৯৪ উত্তরণ – সন্দীপ রায়
১৯৯৪ সোপাণ – অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৯৯ অসুখ – ঋতুপর্ণ ঘোষ
২০০০ পারমিতার একদিন – অপর্ণা সেন
২০০১ দেখা – গৌতম ঘোষ
২০০২ সাঁঝবাতির রূপকথারা – অঞ্জন দাস
২০০২ আবার অরণ্যে- গৌতম ঘোষ
২০০৩ পাতালঘর – অভিজিৎ চৌধুরী
২০০৪ Schatten der Zeit (শ্যাডোস অফ টাইম ) – ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবারগার
দেবীপক্ষ-রাজা সেন
২০০৫ ফালতু -অঞ্জন দাস
২০০৫ নিশিযাপন-সন্দীপ রায়
২০০৫- ১৫ পার্ক অ্যভিনিউ – অপর্ণা সেন
২০০৬ দ্য বঙ কানেকশন – অঞ্জন দত্ত
২০০৭ চাঁদের বাড়ি – তরুণ মজুমদার
বালিগঞ্জ কোর্ট-পিনাকী চৌধুরী
২০০৯কালের রাখাল-শেখর দাস
কালবেলা-গৌতম ঘোষ
অংশুমানের ছবি-অতনু ঘোষ
দ্বন্দ্ব-সুমন ঘোষ
২০১০
আরোহন-পিনাকী চৌধুরী
বাঁশিওলা-অঞ্জন দাস
২০১১
আমি আদু-সোমনাথ গুপ্ত
নোবেল চোর-সুমন ঘোষ
২০১২
অপরাজিতা তুমি-অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী
হেমলক সোসাইটি-সৃজিত মুখোপাধ্যায়
২০১৩
রূপকথা নয়-অতনু ঘোষ
শূন্য অঙ্ক-গৌতম ঘোষ
অলীক সুখ-নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
মাছ মিষ্টি এন্ড মোর-মৈনাক ভৌমিক
২০১৪
ছায়া মানুষ-অরিন্দম দে
আলো ছায়া-অনুসুয়া সামন্ত
পুনশ্চ-সৌভিক মিট
২০১৫
বেলাশেষে-নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
বোধন-অনুসুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
২০১৬
পিস হ্যাভেন-সুমন ঘোষ
প্রাক্তন-নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
২০১৭
পোস্ত-নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
২০১৯
বসু পরিবার-সুমন ঘোষ
সাঁঝবাতি-লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ও শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৬১এই বছরটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনে একটা মাইলস্টোন বছর। ওই বছরেই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত ছবি ‘ঝিন্দের বন্দী’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে সৌমিত্রকে প্রথম দর্শক পেয়েছিলেন একটি খল-চরিত্রে। যে অভিনেতা অপু হিসেবে দর্শকের মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’ অথবা ‘সমাপ্তি’-তে যে সুদর্শন নায়ক ঝড় তুলেছেন মহিলা দর্শকের মনে, সেই অভিনেতাকে তপন সিনহা দিলেন একটি নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। তখনও বাংলার দর্শকের সাহিত্য পড়ার অভ্যাস ছিল প্রবল। উপন্যাসে ময়ূরবাহনকে একজন অত্যন্ত সুদর্শন ও লম্পট যুবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন শরদিন্দু। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের। অভিনেতার পেশাগত জীবনে তাই এই বছরটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
তিনিই হলেন সত্যজিৎয়ের ফেলুদা এবং অপু। তিনি কোনটা বেশি ফেলুদা নাকি অপু, তা বলা বড় দায়। তবে ফেলুদা হওয়ার আগে থেকেই ফেলুদার বিশাল ভক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু নিজে ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করবেন তা কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেননি সৌমিত্র।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি যে, একদিন আমিই এই চরিত্রে অভিনয় করব। যে দিন মানিকদা আমাকে প্রথম ডেকে বললেন যে, আমি ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে ‘ফেলু মিত্তির’ চরিত্রে অভিনয় করব কিনা, আমি শুনেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।” এরপরেই ১৯৭৪ সালে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন তাঁর ‘সোনার কেল্লা’। আর সৌমিত্র হয়ে ওঠেন ফেলুদা। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ১৯৬৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প। ফেলুদা সিরিজে রয়েছে মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস। যদিও সত্যজিতের হাত ধরে রুপোলি পর্দায় ফেলুদাকে দেখা যায় কেবল দুবার। “সোনার কেল্লা” (১৯৭৪) ও “জয় বাবা ফেলুনাথ” (১৯৭৮) এই দুটি ছবিতেই ফেলুদার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র। যেন সত্যজিৎয়ের ফেলুদার স্কেচ থেকে উঠে এসেছেন সৌমিত্র, নয়তো ফেলুদার চরিত্রে সৌমিত্রকে ভেবেই স্কেচ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। ফেলুদার অনেক বইয়ের কভারে ফেলুদার মুখের সাথে প্রচুর মিল রয়েছে সৌমিত্রর। তবে সত্যজিৎয়ের শুরুর স্কেচগুলি ছিল একটু আলাদা। সাক্ষাৎকারে সেকথা স্বীকার করেছিলেন তিনি। তবে কোনদিনও ভাবেননি নিজেকে সেই চরিত্রে দেখবেন তিনি।
যদিও সৌমিত্রের পরে বহু অভিনেতাকে দেখা গিয়েছে ফেলুদার রূপে। কেবল দুটি ফেলুদার ছবিতে অভিনয় করেও তাঁর থেকে সেরা ফেলুদা হয়তো আর কেউ হতে পারবে না। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর মানিকদা থাকলে হয়তো আরও ফেলুদার ছবিতে অভিনয় সুযোগ পেতেন তিনি। তিনি বলেন, “ফেলুদা, আমি আর মানিকদা ছিলাম একটি সুখী ত্রিভূজীয় প্রেমকাহিনির তিনটি চরিত্র।” বাঙালি দর্শকের মনে এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছে সৌমিত্রর ফেলুদা। সেখানে সর্বদাই চিরউজ্জ্বল থাকবে তাঁর ও তাঁর মানিক দার ফেলুদা।
১৯৭০ সালে যখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, অভিনেতা সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। এর কারণটি তিনি বিশদে বলেছিলেন পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ে বলেন, ”ওই সময়ে সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য তেমন কিছুই করছিল না। তাই আলাদা করে একজন ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে ওই পুরস্কার আমি নিতে চাইনি।”সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুবার ফ্রান্সের দুটি সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হন।
‘অর্ডার দি আর্ট এ দে লেটার’ হল শিল্পীদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ থেকে তিনিই প্রথম এই সম্মানে ভূষিত হন।
‘লিজিয়ঁ অফ অনার’ হল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান, এদেশের ভারতরত্ন-র সমতুল্য। প্রথম ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে ২০১৮ সালে এই সম্মানে ভূষিত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহু চরিত্রকে চিরস্মরণীয় করে গিয়েছেন পর্দায়। তিনি মানেই ‘অপু’ আবার এখনও তিনি মানেই ‘ফেলুদা’ বাংলার দর্শকের কাছে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবির বাইরে এমন দুএকটি ছবি এবং চরিত্র রয়েছে যার সংলাপ অথবা দৃশ্য, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে কিংবদন্তি-স্বরূপ হয়ে রয়েছে। তার প্রথমটি অবশ্যই ‘কোনি’ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ– ‘ফাইট কোনি ফাইট’। সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিতে বাংলার পপুলার কালচারে এখনও এই সংলাপটি ঘুরে ফিরে আসে। আরও একটি সংলাপ দর্শকের মুখে মুখে ফেরে, যে সংলাপটি তাঁর নয়, কিন্তু ওই সংলাপটি বলা হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রের উদ্দেশে। ছবিতে সেই সংলাপটি যতবার এসেছে, ততবারই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নীরব থেকেছেন আর তাঁর সেই নীরবতা যে কতটা মর্মভেদী, ওই চরিত্রটি যে কতটা অসহায়, যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা কোনওদিনই ভুলতে পারবেন না। ছবির নাম ‘আতঙ্ক’ এবং সংলাপ– ‘মাস্টারমশায়, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।’ তিনিই বড় অভিনেতা যাঁর অভিনয়ের জন্য সংলাপের প্রয়োজন হয় না! ঘটনাচক্রে ওই দুটি ছবিই মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে।
ছবির পাশাপাশি টেলিভিশনেও ফেলুদার চরিত্রে দেখা মিলেছে সৌমিত্রর। ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা ও গোলোকধাম রহস্য নিয়ে দুটি টেলিফিল্মে অভিনয় করেছিলেন এই কিংবদন্তী অভিনেতা। যা পরিচালনা করেছিলেন বিভাস চক্রবর্তী।
এবার আসা যাক তাঁর নাটকে অভিনয় প্রসঙ্গে।তিনি চলচ্চিত্রে সাফল্যের পরেও মঞ্চেও সমান তালে অভিনয় করে গেছেন।তিনি নাটকে অভিনয়, নির্দেশনা, নাট্য রচনা,রূপান্তর সবেতেই তাঁর বিচরণ।
তাঁর অভিনীত ও নির্দেশিত নাটকগুলি হল
১৯৬৩ তাপসী
১৯৭৮ নামজীবন
১৯৮৩ রাজকুমার
১৯৮৭ ফেরা
১৯৮৮ নীলকন্ঠ
১৯৯০ ঘটক বিদায়
১৯৯২ দর্পণে শরৎশশী
১৯৯৪আরোহন
১৯৯৪ চন্দনপুরের চোর
১৯৯৫ টিকটিকি
১৯৯৮ প্রাণতপস্যা
২০০০আয় একটি দিন
২০০৪কুরবানি
আত্মকথা
২০১০তৃতীয় অঙ্ক
তাঁর পরিচালনায় ‘ফেরা’ নাটকটি শততম রজনী পার করে।নাটকের প্রেমকে সজীব রাখতে অনেক পরিশ্রম করেছেন।শুটিং শেষে দৌড়েছেন মঞ্চে অভিনয় করতে।কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি মঞ্চ অভিনয় ছাড়েননি।
নাটক ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম প্রেম আর দ্বিতীয় প্রেম ছিল সাহিত্য। তিনি এবং নির্মল আচার্য ১৯৬১ সালে তৈরি করেছিলেন ‘এক্ষণ’ নামে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা। মননশীল পাঠকরা ওই পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন সত্যাজিত রায়।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। তিনি সম্পাদনার কাজ করতেন, লিখতেন আবার বিজ্ঞাপনও যোগাড় করার জন্য ছুটে বেড়াতেন সেই সময়ের মহাব্যস্ত নায়ক।
পত্রিকার জন্য যেমন সিরিয়াস প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি, তেমনই লিখেছেন অসংখ্য কবিতা। প্রকাশিত হয়েছে তার কবিতার আর নাটকের বই।তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকাশিত কবিতা বই-‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবে বলে’,এরপর ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্র মালা’,’শব্দরা আমার বাগানে’,’পড়ে আছে চন্দনের চিতা’,’হায় চিরজল’,’কবিতা সমগ্র’,’ক্যালিডোস্কোপ’ ইত্যাদি।এছাড়া ‘নাতি নাতনির ছড়া’,’ছড়া সংগ্রহ’।তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘মানিকদার সঙ্গে’,’গ্রন্থি’,’পরিচয়’ ইত্যাদি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬০ সালের ১৮এপ্রিল।তাঁর স্ত্রীর নাম দীপা চট্টোপাধ্যায়।রয়েছে এক পুত্র সৌগত চট্টোপাধ্যায় ও কন্যা পৌলমি চট্টোপাধ্যায়।তাঁর মেয়ে পৌলিমী চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব।
ছোটবেলা থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবির প্রতি ভালবাসা ছিল। কারণটা ভারতবিখ্যাত শিল্পী রবীন মণ্ডল। তিনি তখন হাওড়াতে থাকতেন। তাঁরই সাহচর্যে ছবির প্রতি প্রেম তৈরি হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের।
২০১৩ সালে কলকাতায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল।তার পর দু’বার আমদাবাদ এবং বডোদরায় সৌমিত্রদার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে।
জীবনে পেয়েছেন বহু পুরস্কার
১৯৭৯সালে ‘গনদেবতা’ ছবির জন্য পান ‘ফিল্ম ফেয়ার’ পুরস্কার।
১৯৮৩সালে ‘অগ্রদানি’ ছবির জন্যও ফিল্ম ফেয়ার পান।
১৯৯২ সালে ‘অন্তর্ধান’ ছবির জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে বিশেষ জুরি পুরস্কার পান।১৯৯৫ সালে ফিল্মফেয়ার প্রদত্ত ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’-এ ভূষিত হন।২০০৪সালে ‘পদ্মভূষণ’,২০১২ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত ‘দাদা সাহেব ফলকে’ পুরস্কার,২০১৪ সালে ‘রূপকথা নয়’ ছবির জন্য ‘ফিল্ম ফেয়ার’ পুরস্কার পান।
৮৬ বছরে শেষ হল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মময় পথচলা। হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চলে গেলেন বাংলা ছবির প্রবীণ মহাতারকা,অভিনেতা-নাট্যকার-বাচিকশিল্পী-কবি-চিত্রকর।
চল্লিশ দিন ধরে যমে-মানুষে চূড়ান্ত টানাপোড়েন। হার মানলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । রবিবার বেলা ১২টা ১৫ নাগাদ না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন ‘ফেলুদা’। শোকস্তব্ধ বিনোদনদুনিয়া। চোখের জলে ভাসছেন অনুরাগীরা।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কিছুদিন আগেই শুটিংয়ে যোগ দিয়েছিলেন প্রবাদপ্রতীম শিল্পী। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় তাঁর জীবন নির্ভর সিনেমা ‘অভিযান’-এর শুটিং সম্পূর্ণ করেছিলেন। ছবিতে অল্প বয়সের সৌমিত্রর চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিশু সেনগুপ্ত । বেশি বয়সের চরিত্রে সৌমিত্র নিজেও অভিনয় করেন। অভিনেতা ছাড়াও একাধিক ভূমিকায় নিজের কীর্তির ছাপ রেখে গিয়েছেন সৌমিত্র। ছিলেন নাট্যকার, লেখক, কবি, চিত্রশিল্পী। সৃষ্টিশীলতাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাতেই সমর্পিত করেছিলেন প্রাণ। করোনা থাবা শরীর কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু কালের নিয়মের তোয়াক্কা না করেই শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। নিজের সৃষ্টির এই ‘অভিযান’-এই অমর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
ছবি:বিশ্বজিত সাহা