আনন্দ সংবাদ লাইভ: প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের কিতাব শীর্ষক অনুষ্ঠানে শশী থারুরের সাম্প্রতিকতম বই “দ্য ব্যাটেল অফ বিলংগিং” এর পুস্তকপ্রকাশনা করেন প্রধান অতিথি প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি সহ জে অ্যান্ড কে ন্যাশনাল কনফারেন্সের চেয়ারম্যান ফারুক আবদুল্লা, ঔপন্যাসিক ও প্রকাশক ডেভিড দাভিদার, প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ তথা কূটনীতিবিদ পবন কুমার বর্মা, আইআইএএস এর ডিরেক্টর মকরন্দ পরঞ্জপী। শশী থারুর এই বইটির প্রেক্ষাপটে নিহিত অনুপ্রেরণার বিষয়ে উল্লেখ করেন এবং বিস্তর গবেষণা করে লিখিত বইটি পড়ার আবেদন জানান পাঠকদের।
প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন ও অ্যালেফ বুক কোম্পানীর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পুস্তকপ্রকাশনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন এহসাস উইমেনের সদস্যা অপরা কুচ্চল এবং সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন সাংবাদিক করণ থাপার। শশী থারুরের ২২তম বইটি আলোকপাত করেছে বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপর। দেশ ও দেশের বাইরের বই-প্রেমীরা অংশ নেন এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে।
ভারতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা ও বিশ্লেষণধর্মী বিতর্কের উত্থাপন করে সম্প্রতি প্রকাশিত এই বইটি। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বইটির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ জাতীয়তাবাদ, দেশাত্মবোধ, নাগরিক জাতীয়তাবাদ, ভারত সম্পর্কে ধারণা প্রভৃতি বিষয়ের নিখুঁত বর্ণনা রয়েছে এই বইতে।
“ভারতকে বোঝার জন্য এই বইটি পড়ার আন্তরিক আবেদন জানাচ্ছি। “দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতকে বরাবর ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়েছে, যে ভারত এখন আমরা ওরা বিভাজনের নাগপাশে জর্জরিত। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে উঠে আসা ভারতীয়তার প্রতিচ্ছবি ও স্বাধীনতা পরবর্তী সাতটি দশকে প্রজাতান্ত্রিক ভারতের যে পরিবর্তিত রূপ, এই দুইয়ের মধ্যে বিভেদকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শশী থারুর। নাগরিকত্বের পরিচায়ক, দেশাত্মবোধে সমৃদ্ধ বইটি ভুল-ত্রুটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের পরিবর্তে পাঠকের মধ্যে নতুন বোধের ও দিশার সঞ্চার ঘটাবে।
অ্যালেফ বুক কোম্পানীর পক্ষ থেকে ‘দ্য ব্যাটেল অফ বিলংগিং’ এর প্রকাশক ডেভিড দাভিদার বলেন, “আশা করি ভারতীয়রা এই বইটির যোগ্য সমাদর করবে। মৌলিক চিন্তা ও তথ্যে ভরপুর বইটির জন্য যে গবেষণা করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে মুগ্ধ করে। দুর্মূল্য এবং অপরিহার্য বইয়ের সরণীতে ‘দ্য ব্যাটেল অফ বিলংগিং’ কে রাখা যায়। আশা করছি ভারতকে অনুভব করার জন্য পঞ্চাশ বছর পরেও এই বইটি জনগণ পাঠ করবে”।
এই বইটি লেখার কারণ সম্পর্কে শশী থারুর বলেন, “দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সারাজীবন ধরে লব্ধ জ্ঞান, বিভিন্ন বই পাঠ, যুক্তিতর্ক ও বিতর্কের নির্যাস এই বইটি। থিয়োরি ও অ্যাকাডেমিক তথ্যের থেকও অনেক বেশী রসদ রয়েছে এই বইতে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত ‘ফান্ডামেন্টাল চ্যালেঞ্জ’ এর ব্যাখ্যা করার অনুরোধে এই বইটি লিখেছি। ভারতের সাম্প্রতিক টানাপোড়েন ও সুস্থিরতার অভাবে জাতীয়তাবাদ কিভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তা এই বইয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে এক পরিদর্শকের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। ঔপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয়তাবাদ ভারতে এক ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি এই জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এটিই হল ভারতের অধিকারভুক্ত সম্পদ রক্ষার লড়াই। বইটির সারমর্ম লুকিয়ে আছে এর মধ্যেই”।
লেখকের অভিমত বর্তমানে ভারতে যে জাতীয়তাবাদ আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার মধ্যে জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষার মত অনস্বীকার্য বিষয়ের নিরীখে অনেকাংশে জনগণই বাদ পড়ছে। তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানগুলিতে নাগরিক জাতীয়তাবাদের প্রচলন শুরু হয়েছে। জনগণতান্ত্রিক মুক্তমনা সমাজে সাধারণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যেই নাগরিক জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি যা ব্যাক্তি অধিকারকে সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে।
এই বইয়ের মধ্যে থারুর বলেছেন, দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবাদ দুটি ভিন্ন বিষয়। একজন দেশপ্রেমিক দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত যেখানে জাতীয়তাবাদীরা দেশের স্বার্থে অন্যের প্রাণ নিতে পিছ পা হয়না। তবে অধিকাংশ প্যানেলিস্ট এই মন্তব্যে সহমত হননি। যেমন পবন কুমার বর্মা এটিকে “বৌদ্ধিক বাকচাতুরি” বলে অভিহিত করেন।
সঞ্চালক করণ থপারের প্রশ্নে ফারুখ আবদুল্লা বলেন, “বর্তমানে আমরা ধর্ম, জাতিবিভেদ, ভাষার বিভেদের কারণে বিভক্ত। আমরা কি আদৌ শক্তিশালী ভারত গঠন করতে পারছি নাকি আদতে এটির প্রাচীণ ঐতিহ্য নষ্ট করছি! শশী থারুরের এই বইটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এক পদক্ষেপ। একটি কথা আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, যতই অত্যাচারী শাসক আসুক না কেন দেশ বা জাতি তার অস্তিত্বরক্ষা করবেই। যে অশুভ শক্তি ধর্ম, জাত ও ভাষার বিভেদের কারণে আমাদের মধ্যে ব্যবধান তৈরী করতে উদ্যত তার সঙ্গে আমাদের লড়াই করতে হবে”।
কবি-ঔপন্যাসিক মকরন্দ পরঞ্জপী বিবিধ বিষয়ে লেখকের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। তিনি বলেন, “ভারত সম্পর্কে বর্তমান ধারণা যথেষ্ট জটিল এবং নেহেরুকেন্দ্রিক যে ইতিবাচক ধারণার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠেছি সেই মনোভাব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেছে। শশী থারুরের এই বইটি নিঃসন্দেহে বহু অনাবিস্কৃত দিক উন্মোচন করবে, জন্ম দেবে অনেক বিতর্কের কিন্তু ভারতে ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদের’ উন্মেষ হয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করিনা। আমার মতে ভারতে বরাবর বহুমাত্রিক ও ‘সভ্যতাকেন্দ্রিক জাতীতাবাদের’ প্রচলন রয়েছে। থারুর মনে করেন ভারতীয় সংবিধান একটি পবিত্র বই যার পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু এতবছরে ১০৩ বার এটি সংশোধিত হয়েছে। জরুরী অবস্থা চলাকালীন ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নিমেষের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু আমরা সমাজতান্ত্রিক নই। আপাত এক ভন্ডামির মধ্যে ডুবে রয়েছি আমরা। জাতিবৈষম্য, ভাষাকেন্দ্রিক বিভেদ, ধর্মীয় ভেদাভেদ থেকে যে রাজনীতির সূত্রপাত তার বলি করবেন না আমাদের”।
শশী থারুরের বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্কপ্রসূত এই বইটির যথেষ্ট উপযোগীতা রয়েছে বলে মনে করেন পবন কুমার বর্মা। তবে তিনি বইটির কিছু অসম্পূর্ণতা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “কোন ধর্ম নিয়ে অতিরিক্ত গোঁড়ামি কাম্য নয়। যেমন আপনার বইটিতে ইসলামিক মৌলবাদের বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। যদি আমাদের দেশে এই অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে আপনার উচিত সেগুলির তীব্র সমালোচনা করা নাহলে আপনার বইটি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়বে। ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট নয় যেটি সভ্যতার ঊষালগ্নকে সূচিত করে এবং একইসঙ্গে নবভারত গঠনে যেটির অবদান রয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা পালনে ভারতের সীমাবদ্ধতার বিষয়েও পবন কুমার বর্মা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষ বহু ভারতীয় আজও মন্তব্য করেন, ‘গান্ধীজি কেন খিলাফৎ আন্দোলন সমর্থন করেন’? জওয়াহরলাল নেহেরু কেন সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধনে উপস্থিত না থাকার জন্য ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদকে কেন চিঠি লেখেন? শুধুমাত্র হিন্দুদের ব্যাক্তিগত আইন কেন পরিবর্তিত হল? কেন শাহ বানোর মামলার রায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্থগিত করা হল? এই প্রশ্নগুলির সাথে আমরা বহুদিন ধরে অভ্যস্ত। বর্তমানে অস্থিরতা তৈরীর উদ্দেশ্যে আমরা অতীত নিয়ে বিশ্লেষণ করছিনা। বহুদিন এই প্রশ্নগুলি উত্থাপিত না হওয়ায় ভারতের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরী হয়নি। এখন এগুলি উত্থাপন করা হচ্ছে এই প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার জন্য। গান্ধীজির উদ্দেশ্য মহৎ হলেও তার পরিণাম সম্পর্কে আমাদের নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করা উচিৎ”।
প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশনের বিশেষ একটি উদ্যোগ হল সন্দীপ ভূতোড়িয়ার মস্তিষ্কপ্রসূত ‘কিতাব’ শীর্ষক পুস্তক প্রকাশনা অনুষ্ঠান। কিতাব লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবি, সুচিন্তকদের বই প্রকাশের পাশাপাশি চিন্তাউদ্রেককারী ও উদ্দীপক বিষয়ে মতামত প্রকাশের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।