আনন্দ সংবাদ লাইভ :বৃহস্পতিবার নীরবে চলে গেলেন চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক।বৃহস্পতিবার বিকেলে সোদপুর পানিহাটির বাড়িতে তিনি প্রয়াত হয়েছেন ৯৪ বছর বয়সে। শেষ জীবনে ভিক্ষার অন্নে পেট ভরিয়েছেন।আশি পেরোনো বৈদ্যনাথ বসাক খেতে যেতেন ৫০ জনের সঙ্গে লাইন দিয়ে।এই মানুষটি উত্তমকুমারের ৭২টি ছবিতে কাজ করা শিল্পী।
৯৪ বছরের এই বৃদ্ধ মানুষটিকে নিয়েই ২০১৮ সালে উত্তাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া। সে ঢেউয়ে উত্তাল হয় সংবাদমাধ্যমও, যার রেশ এসে পড়ে টালিগঞ্জ পাড়াতেও। কারণ টলিউডের বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক ছিলেন এই মানুষটি। বয়সের ভার যাঁকে ঠেলে দিয়েছিল অনটনের চরম সীমায়। তাঁর কথা সামনে আসার পরে অভাবী চোখের জল মোছাতে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, মাধবী মুখোপাধ্যায়, মমতা শংকর থেকে শুরু করে নায়ক দেবও পাশে দাঁড়ান।
বার্ধক্যজনিত অসুখে মৃত্যু হল স্বর্ণযুগের এই ক্যামেরাম্যানের। কিন্তু অনেকেরই প্রশ্ন, তাঁর অবদান কী? কেনই বা তিনি চর্চায় এসেছিলেন এত পরে ?
তাঁর কথা সামনে আসার পরে জানা যায়, প্রতিদিন চার কিলোমিটার হেঁটে রামকৃষ্ণ মিশনে যেতেন আসতেন বৃদ্ধ মানুষটি। শুধুমাত্র দু’বেলার ভাতের জন্য এত কষ্ট। আশ্রমের দরিদ্রভোজনে এক পঙক্তিতে বসে যেতেন তিনি। তাঁকে কেউ চিনতেও পারতনা। ভাত খাওয়া শেষে নিজের থালা নিজেই ধুয়ে ভরে নিতেন হাতের ঝোলায়। গাছতলায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফের হেঁটে বাড়ি ফেরা। এই ছিল তাঁর রোজকার রুটিন। অথচ তাঁরই চিত্রগ্রহণে তোলা পুরনো বাংলা ছবিগুলো ঘরে-ঘরে চলে এখনও। কিন্তু তাঁর পাড়ার লোকই সঠিক ভাবে চিনত না তাঁকে। সম্মান দূরের কথা।
অথচ একসময়ে রাজ কাপুর থেকে উত্তম কুমার– সকলের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। উত্তম কুমারের সঙ্গে ক্যামেরাম্যান হিসেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন তিনিই। উত্তমকুমারের ৭২টি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার এক গৌরবোজ্বল ইতিহাস রয়েছে বৈদ্যনাথ বসাকের। কিন্তু সময় বড় নির্মম। বহু শিল্পী-টেকনিশিয়ানকেই শেষ জীবনে এ ভাবে কষ্ট পেতে হয় সময়ের ফেরে। নইলে যে মানুষটির লাঞ্চ কিংবা ডিনারের সঙ্গী ছিলেন তত্কালীন লেজেন্ড তারকারা, আজ সেই বিশিষ্ট ক্যামেরাম্যান ফুটপাতে বসে একই সারিতে ভিক্ষুকদের সঙ্গে খেতেন!
একসময়ে অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এক বাংলা ফুটবলের প্রাক্তন তারকা রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়। সব শুনে মানুষটিকে চিনতে পারেন সাবিত্রী দেবী। তিনিই বলেন, “উনি বৈদ্যনাথ বসাক। পারলে ওঁর জন্য কিছু করুন। উত্তমকুমারের সবচেয়ে বেশি ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন উনিই। আজ উনি বড় কষ্টে রয়েছেন।”
২০১৮ সালেই পরিচালক রাজ বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করেন ‘পাড় দ্য রিভার ব্যাঙ্ক’। সেই ছবিতে অশীতিপর বৈদ্যনাথ বসাককে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। এটাই ক্যামেরাম্যান হিসেবে বৈদ্যনাথবাবুর শেষ কাজ হয়ে রইল।
বছর পনেরো আগে বৈদ্যনাথের স্ত্রী সরস্বতী দেবী প্রয়াত হন। ছেলের সঙ্গেই থাকতেন তিনি। ছেলে সঞ্জয় বসাক এক ডেকরেটর্সের দোকানের সামান্য আয়ের কর্মচারী। স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে তাঁরও অভাবের সংসার। তার মধ্যেই একফালি জায়গা বৈদ্যনাথের রাতের ঠিকানা ছিল।
পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর কয়েক তিনি ছিলেন নেপালের রাজপরিবারের আলোকচিত্রীও ছিলেন। শোনা যায়, রাজা মহেন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি রয়্যাল গেস্ট হাউসে থাকুন। ২৪ ঘণ্টার জন্য আপনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন রাজপরিবারের নিরাপত্তারক্ষীরা।” কিন্তু শিকড়ের টানে কলকাতাতেই ফিরে আসেন তিনি।
১৯৫৪ সালে “বুট পালিশ” ছবি প্রযোজনা করছেন রাজ কাপুর। সেই ছবিতেই চিত্রগ্রাহক হিসেবে প্রথম কাজ করেছিলেন তরুণ তুর্কী বৈদ্যনাথ।এছাড়া ‘কিতনে দূর’,মনোজ কুমার গোস্বামী,মালা সিনহা,শশী কলা অভিনীত ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’ ছবির সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন বি.এন.বসাক।তখন মুম্বাইতে2 তিনি এই নামেই পরিচিত ছিলেন।পরের বছরই রাজকাপুর নিজেই পরিচালনা করেন “শ্রী ৪২০”। সেই ছবিতেও বৈদ্যনাথকে ক্যামেরায় থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান রাজ কাপুর। কিন্তু ততদিনে বম্বে থেকে তিনি চলে এসেছেন কলকাতায়। চুক্তি করেছেন অগ্রদূত পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত “অগ্নিপরীক্ষা” ছবির জন্য। সিনেমাটোগ্রাফিতে বিভূতি লাহা এবং বিজয় ঘোষের সহকারী হিসেবে ক্যামেরার কাজ শুরু করলেন বৈদ্যনাথ বসাক। রাজ কাপুরের অফার ফিরিয়ে দেন শুধু বাংলা ছবি করার স্বার্থে।
সবার উপরে, লালু ভুলু, সাগরিকা, সোনার খাঁচা, সূর্যসাক্ষী, অগ্নিপরীক্ষা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ছদ্মবেশী, নায়িকা সংবাদ, বাদশা, অপরাহ্নের আলো, আপন ঘরে-র মতো বহু নামকরা ছবিতে চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। প্রতিটি ছবিই বাংলা ফিল্মের মাইলফলক। বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও মালয়ালম, ওড়িয়া ও ভোজপুরী ছবিতেও কাজ করেছেন বৈদ্যনাথ। অনেকেই বলতেন, তাঁর ক্যামেরার গুণেই উত্তম কুমারকে পর্দায় এত সুন্দর লাগত।
কিন্তু ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি। অভাব ও বয়স রুপোলি জগত থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল তাঁকে। এর পরে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এগিয়ে আসার পরেই ফেসবুক-সহ সংবাদমাধ্যম মহল নড়েচড়ে বসে। খবর রটে টালিগঞ্জ পাড়া অবধি। মাধবী মুখোপাধ্যায় অতীতের স্মৃতি ঘেঁটে বলেন, “বৈদ্যনাথবাবুর সঙ্গে ‘ছদ্মবেশী’তে কাজের কথা মনে পড়ছে। উনি খিদে পেলেও বলতেন না। কাজটা আগে করতেন।” খিদে সহ্য করতে পারা সেই মানুষটিই শেষজীবনে দরিদ্রভোজনের লাইনে বসতেন খিদের জ্বালায়। এর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা বোধহয় আর হয় না জীবনের।
শেষ বয়সে বৈদ্যনাথ বসাকের দিকে হাত বাড়িয়েছিল টালিগঞ্জ পাড়া, এটাই তাঁর প্রাপ্তি। কিন্তু সুখ সইল না বেশিদিন। গত , ৪ জুন বৈদ্যনাথবাবু নীরবে চলে গেলেন। শেষ যাত্রাও নীরবে হল। শেষ বিদায়েরে পর খবর এল। বৈদ্যনাথ বসাকের মতো কারিগররা এভাবেই আকাশে মিলিয়ে যান অনেক কষ্টের খেসারত দিয়ে।