সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় :সেই কবে হেলায় লঙ্কা জয় করেছিলেন বিজয় সিংহ। কিন্তু আজও বঙ্গ সন্তানের কৃতিত্বে গর্বিত হই। এই মুহূর্তে বাঙালিকে গর্বিত করলেন বিশিষ্ট হিসাববিদ ড: দেবাশিস মিত্র। হিসাব বিদদের আন্তর্জাতিক সংগঠন দি ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারনাল অডিটরস্ এর ছটি কেন্দ্র আছে ভারতে। মূল কার্যালয় লেক মেরি, ফ্লোরিডা ইউ এস এ।ভারতে সংগঠনের ছ টি কেন্দ্র ব্যাঙ্গালুরু, দিল্লি, হায়দরাবাদ, চেন্নাই,মুম্বাই ও কলকাতায়। ড: মিত্র ছিলেন কলকাতা কেন্দ্রের প্রাক্তন সভাপতি। এই মুহূর্তে ড: দেবাশিস মিত্র ইনস্টিটিউট অফ চাটার্ড একাউন্টেন্ট অফ ইন্ডিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
ড:মিত্রের এই সম্মানে নিজেদের সম্মানিত বোধ করছে অডিটরস্ সংগঠনের কলকাতা কেন্দ্র। সংগঠনের তরফে শনিবার সন্ধ্যায় মধ্য কলকাতার এক বনেদি বিলাসবহুল হোটেল ব্যাংকোয়েটে আয়োজিয় হয় এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। সম্বর্ধনা দেন সংগঠনের কলকাতা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত বর্তমান সভাপতি অরিজিৎ রায়। সাংবাদিকদের সঙ্গে ডঃ মিত্রকে পরিচিত করিয়ে অরিজিৎ রায় বলেন, সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সভায় ড:মিত্র'র এই সম্মান প্রাপ্তিতে আমরা দি ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারনাল অডিটরস্ সকল সদস্য ও ব্যক্তিগত ভাবে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি হওয়ার সুবাদে ড:মিত্রকে সম্বর্ধনা দিয়ে নিজেরা গর্বিত হচ্ছি। কারণ কলকাতা কেন্দ্রের প্রাক্তন সভাপতি ছিলেন ড:মিত্র।সম্প্রতি মুম্বাইতে হতে চলেছে গ্লোবাল একাউন্টেন্টস্ কংগ্রেস। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন ড:মিত্র। এটাও আমাদের জন্য গর্বের।
সভ্যতার আদি যুগ থেকেই বিশ্বে জলপথে বাণিজ্যের এক ঐতিহ্য ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর নতুন নতুন দেশের আবিষ্কারের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিধি বিস্তৃতি লাভ করেছে। কিন্তু বাণিজ্যের হিসেব নিকেশের ওপর নির্ভর করে লাভ ক্ষতি। ফলে অর্থশাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মানুষ উপলব্ধি করে ।বিক্ষিপ্তভাবে সে কাজ চলতে থাকে। ১৮৯৪সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম পেশাদারী হিসাববিদদের সংগঠন দি ইনস্টিটিউট অফ চাটার্ড এ্যাকাউনটেন্টস অফ ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস্ গড়ে ওঠে। এরপর প্রায় একশো বছরের ব্যবধানে স্বাধীনতার দুবছর পর ১৯৪৯সালে ভারতে গড়ে ওঠে দি ইনস্টিটিউট অফ চাটার্ড এ্যাকাউনটেন্টস অফ ইন্ডিয়া। দিনটি ছিল ১৯৪৯এর,১জুলাই।তারপর থেকে দেশজুড়ে দিনটি চাটার্ড এ্যাকাউনটেন্টস দিবস পালিত হচ্ছে।স্বাভাবিক ভাবেই চলতি বছরের ১জুলাই হিসাববিদ ড:দেবাশি মিত্র'র জীবনে এক অন্য মাত্রা দেবে আশা করাই যায়।
এদিন সন্ধায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর ড:দেবাশিস মিত্র জানান
আমাদের পেশায় অনেক গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়। ফলে একজন পেশাদার চাটার্ড এ্যাকাউন্ট অন্তর্মুখী হয়ে পড়েন। কিন্তু দিন এখন পাল্টেছে। ডিজিট্যাল দুনিয়ার নিরিখে বিশ্বটাই এখন হাতের মুঠোয়। একটি গ্লোবাল ভিলেজ।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ড:দেবাশিস মিত্র জানান, এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এসে নিজেকে যেমন গর্বিত লাগছে,ভালো লাগছে আমি প্রতিনিধিত্ব করছি আমার সহকর্মীদের। বিশ্বে এই সংগঠন দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগঠন। আমরা ১০বছর পর পর এই পেশাদারী বৃত্তির সিলেবাস সময়ের নিরিখে পরিবর্তন,পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রবল আলোড়ন উঠেছে। এখন শুধু কোনও দেশ নিজস্ব অর্থনীতি নির্ভর হয়ে থাকলে চলবে না। এই পেশা এখন বিশ্বজনীন হচ্ছে। একজন পেশাদার চাটার্ডকে গ্লোবাল এ্যাকাউনটেন্ট হতে হচ্ছে। পেশাদারী মনোভাবে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রয়াত কালাম সাহেব বলেছিলেন , একজন পেশাদারী চাটার্ড সমাজের মানদণ্ড। একই কথা বলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদিজি।
ভারতে জি এস টি প্রথা সফলই হতো না চাটার্ডদের উল্লেখযোগ্য যোগদান না থাকলে। আগে আমরা প্রি বাজেট মেমোরণ্ডম নিয়ে পর্যালোচনা করতাম। এখন করতে হয় পোস্ট মেমোরণ্ডমে গুরুত্ব দিচ্ছি। ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে নিয়ে এখন ভাবনাচিন্তা করছি। কিভাবে এর হিসেব রাখা হবে। কিভাবে এর ওপর জি এস টি প্রয়োগ হবে তা নিয়েও পর্যালোচনা চলছে। তাই সিলেবাস পরিমার্জন করতে এবার পাঁচ বছরের মধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ড: মিত্র আরও বলেন, ৬০/৭০ এর দশকে এই পেশায় বাংলার নাম ছিল বিশ্বজোড়া। সন্দেহ নেই এখন সেই যুগ নেই। এই মুহূর্তে দেশে প্রায় সাড়ে তিনলাখ পেশাদারি চাটার্ড আছে। এখন প্রতি বছরে প্রায় ৪০হাজার শিক্ষার্থী পাশ করে বেরোচ্ছেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই স্বাধীন পেশায় নয়,চাকরিতে ঝুঁকছেন। প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল, সেকি কর্পোরেট গন্ধের মোহ? ড:মিত্র সহমত হয়ে জানালেন,যেহেতু পেশাটি এখন বিশ্বজনীন হয়ে গেছে তাই নতুন প্রজন্ম বৃহত্তর পরিবেশে যুক্ত হতে চাইছেন। কিন্তু পেশাদার মানে শুধু প্রভূত অর্থ উপার্জন নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতাও থাকে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তাই যেসব চাটার্ড আর্থিক সাফল্যের একটা স্তরে আটকে আছেন তাঁদের করোনা পরিস্থিতিতে এককালীন দেড় লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। সংখ্যা প্রায় হাজার।
প্রশ্ন ছিল,চাকরির অভাবে বহু মানুষ নিজস্ব উদ্যোগে কোনও ব্যবসায় ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেন না ব্যাংকের জটিল পদ্ধতির কারণে। একটি প্রাইভেট লিমিটেড সংস্থা গড়তে চাটার্ড যে আর্থিক মূল্য দাবি করেন তা অনেকের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। উত্তর দিতে গিয়ে ড: মিত্র বলেন, সারা দেশে আমাদের ১৬৫টি শাখা আছে। দেশের ১২টি ভাষায় আমরা বিস্তারিত জানিয়ে ফ্রি ক্যাম্প করছি। গৃহবধূ থেকে রিক্সাওয়ালা সমাজের সব স্তরের মানুষদের পরিষেবা দেওয়ার কথা জানাচ্ছি।
প্রশ্ন ছিল, অনেক ব্যবসায়ীর অভিযোগ,তাঁরা যে চাটার্ড এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন,তাঁরা বিপথে চালিত করে অতিরিক্ত আর্থিক শোষণ করছেন।যা কোনও কোনও সময়ে ব্ল্যাকমেল এর পর্যায়ে চলে যায়। বিষয়টি স্বীকার করে ড:মিত্র বলেন,সমাজের সব স্তরেই দুর্নীতি আছে। আমরাও ব্যতিক্রম নই। তবে আমাদের কঠোর অনুশাসন আছে। পাঁচজনের একটি কমিটি আছে। দুজন এর মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ব্যক্তি। ফলে এমন অভিযোগ পেলে স্বজনপোষণের কোনও সুযোগ নেই। আমরা তাই যুগের প্রয়োজনে ফরেনসিক অডিট এর প্রয়োজন উপলব্ধি করছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে যখন অডিট করি,কখনও বলি না আমার অডিট সম্পূর্ণ নির্ভুল।বলি ভালো অডিট। কিন্তু অনেকগুলি প্রেক্ষিতেই বিষয়টি বিবেচিত হয়। আশার কথা বিশ্বে ভারতীয় চাটার্ড ও কষ্ট এ্যাকাউন্টেটের চাহিদা বাড়ছে ।যদিও ইউরোপের পেশাদাররা ভারতে কাজ করতে চান,করতেই পারেন। কিন্তু ভারতীয়দেরও বিদেশে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। সেখানেই তাঁদের আপত্তি। আগামী দিনে ভারতীয় অর্থনীতির পেশাদারদের নেতৃত্ব থাকবে এই ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে।